কুরআন এবং সহীহ হাদিসের আলোকে আল্লামা জলিল (রহঃ) এর বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করবো ইন শা আল্লাহ!
আল্লাহ পাক কুরআনের অসংখ্য আয়াতে নাফরমান বান্দাদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বলে বলেছেন যে তিনি নাফরমানকে কিছু সময় দেন। যখন সময় শেষ হয়ে আসবে তখন তিনি তাদেরকে পাকড়াও করবেন। যেমন পবিত্র কুরআনের সূরা হুদে আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন –“তোমাদের রব এভাবে জালিমদের পাকড়াও করবেন। তাঁর পাকড়াও অত্যন্ত কঠিন এবং যন্ত্রনাদায়ক।” (সূরা হুদঃ ১০২)
সূরা আরাফে আল্লাহ পাক বলেনঃ
“তারা কি আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত [নির্ভয়] হয়ে গেছে? বস্তুতঃ আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচার ব্যাপারে একমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত ছাড়া অন্য কেউ ভয়হীন হতে পারে না।” (সূরা আল–আরাফঃ ৯৯)
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ আরও এরশাদ করেন, “নিশ্চয় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে তাঁর সাথে কাউকে শরীক করে। এছাড়া যাকে ইচ্ছা, ক্ষমা করেন। যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে সুদূর ভ্রান্তিতে পতিত হয়।” ( সুরা নিসা ১১৬)
রাসুল (দঃ) কি পাপীদের ক্ষমা করার ইখতিয়ার রাখেন ?
রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে আল্লাহ পাক নিজেই ইহকাল এবং পরকালে পাপিদের ক্ষমা করে দেবার ইখতিয়ার দিয়েছেন। কিন্তু অন্ধরা তা দেখতে পায় না। কারণ তা দেখলে রাসুল (দঃ) এর সুউচ্চ শান ও মান স্বীকার না করে পারবেনা। রাসুল (দঃ) এর সুউচ্চ শান ও মান তারা সহ্য করতে পারেন বলেই তারা হল দুশমনে রাসুল। আর এজন্যেই তারা মনে করে রাসুল (দঃ) আমাদের মতই মানুষ। নাউজুবিল্লাহ!
দেখুন আল্লাহ পাক সূরা নিসার ৬৪ নং আয়াতে কি বলেন।
“আর সেসব লোক যখন নিজেদের অনিষ্ট সাধন করেছিল, তখন যদি আপনার কাছে আসত অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করত এবং রসূলও যদি তাদেরকে ক্ষমা করিয়ে দিতেন। অবশ্যই তারা আল্লাহকে ক্ষমাকারী, মেহেরবানরূপে পেত।” (সূরা নিসাঃ ৬৪)
এখানে লক্ষণীয় বিষয় যে, রাসুল (দঃ) তাদেরকে ক্ষমা করবেন যারা “নিজেদের অনিষ্ট সাধন করেছে“। যে ঈমান এনেছে এবং আল্লাহকে ভয় করে, অর্থাৎ যে মুত্তাকী, পরহেজগার তাঁর কোন ভয় নেই। আর এধরণের লোকেরাই হলেন আল্লাহ পাকের বন্ধু/ওলী। কেননা, আল্লাহ পাক বলেন, “নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে, সৎকাজ করেছে, নামায প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং যাকাত প্রদান করেছে, তাদের জন্যে তাদের পুরষ্কার তাদের পালনকর্তার কছে রয়েছে। তাদের কোন শঙ্কা নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না।” [সূরা বাকারাহ: ২৭৭]
অন্য আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন, “মনে রেখো যারা আল্লাহর বন্ধু, তাদের না কোন ভয় ভীতি আছে, না তারা চিন্তান্বিত হবে।” (সূরা ইউনুসঃ ৬২)
যারা ঈমান এনেছে, সৎ কাজ করেছে, নামাজ প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যাকাত প্রদান করেছে এ ধরণের লোক “নিজেদের অনিষ্টকারী” দলভুক্ত নন। কেননা রাসুল (দঃ) কে এমন লোকদের ক্ষমা করে দেবার ব্যাপারে অধিকার দেয়া হয়েছে যারা নিজদের উপর নিজেরাই জুলুম করেছে। নিজেদের অনিষ্ট সাধন করেছেন। ইহকালে তাদেরকে তিনি ক্ষমা করে দেবার ইখতিয়ার রাখতেন। এমনকি পরকালেও তিনি তাদের জন্য সুপারিশ করার অধিকার রাখেন।
সূরা নিসার ৬৪ নং আয়াতের প্রত্যক্ষ্য প্রমাণ নীচের ঘটনায় পাওয়া যায়। হজরত আবদুর রহমান জামী (রহঃ) তার বিখ্যাত শাওয়াহেদুন নবুয়ত কিতাবে উল্লেখ করেন, ‘হজরত আলী (রাঃ) বলেন, আমরা যখন রাসূল (দঃ)-এর দাফনকার্য সম্পাদন করছিলাম তখন এক বেদুঈন এসে নবীজীর (দঃ) কবরে আছড়ে পড়ল এবং নিজ মাথায় মাটি নিক্ষেপ করতে করতে বলতে লাগল, ইয়া রাসূলুল্লাহ (দঃ), আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘যদি তারা নিজেদের ওপর জুলুম করে অতঃপর আপনার কাছে এসে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে তাহলে আল্লাহ তাদের অপরাধ মার্জনা করবেন (সূরা নিসা : ৬৪)। এখন আমি আপনার দরবারে এই উদ্দেশ্যে উপস্থিত হয়েছি। কিন্তু আপনি তো আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। এখন আমি কোথায় যাব? তখন কবর থেকে আওয়াজ এলো– ‘যাও তোমাকে ক্ষমা করা হয়েছে’। হজরত আলী (রাঃ) বলেন, ওই আওয়াজ উপস্থিত সবাই শুনতে পেয়েছিল। [শাওয়াহেদুন নবুয়ত, মদিনা পাবলিকেশন্স পৃ. ১৪৩–১৪৪]
পরকালে শাফায়াত
——————
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক বলেন, “আল্লাহ তা’আলা যাকে অনুমতি দিবেন সে ব্যতীত আর কারো সুপারিশ কোন উপকারে আসবে না।” (সূরা, আস সাবা, ৩৪:২৩)
অর্থাৎ সেদিন কাউকে কাউকে সুপারিশ করার অনুমতি দেয়া হবে। এ আয়াতের অর্থ না বুঝে আহলে খবিসের দল বলে বেড়ায়, সেদিন কেউ সুপারিশ করতে পারবে না। এমন কি নবী (দঃ) ও না। নাউজুবিল্লাহ। দেখুন সহীহ হাদিস কী বলেঃ
রাসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, কিয়ামতের দিন আমিই হবো সমস্ত নবী রসূল আলাইহিমুস সালামগনের ইমাম ও তাদের খতীব এবং আমিই হবো তাঁদের ছহিবে শাফায়াত এতে আমার কোন ফখর নেই।“
[তথ্যসূত্রঃ– সুনানে তিরমিযী শরীফ, মিশকাত শরীফ ৫১৪ পৃষ্ঠা]
রাসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “কিয়ামতের দিন হাশরবাসীগন বিক্ষিপ্ত ভাবে ছোটাছুটি করে একজন অন্যজনের নিকট চলে যাবে। অতঃপর তারা হযরত আদম আলাইহিস সালামের নিকট এসে বলবে, আপনি আপনার রবের নিকট আমাদের জন্য সুপারিশ করুন। তখন তিনি বলবেন, আমি এখন একাজে উপযুক্ত নই। তোমাদের এ ব্যাপারে ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের নিকট যাওয়া উচিত, কেননা তিনি হচ্ছেন পরম করুনাময় আল্লাহ পাকের খলীল। সূতরাং তারা হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের নিকট এসে সুপারিশ প্রর্থনা করবে। তিনিও বলবেন, আমি একাজে সক্ষম নই। সুপারিশের জন্য তোমরা হযরত মুসা আলাইহিস সালামের কাছে যাও। কেননা তিনি আল্লাহ পাকের সাথে কথা বলেছিলেন। অতপর তারা মুসা আলাইহিস সালামের নিকট আসবে এবং সুপারিশ প্রার্থনা করবে। তিনি বলবেন আমিও সক্ষম নই। তবে তোমাদের হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের কাছে যাওয়া উচিত। কেননা তিনি হচ্ছেন, রুহুল্লাহ। তখন তারা ঈসা আলাইহিস সালামের কাছে আসবে এবং সুপারিশ প্রার্থনা করবে। তিনিও বলবেন আমি এ ব্যাপারে সক্ষম নই। তবে তোমাদের হযরত সাইয়্যিদুনা মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট যাওয়া উচিত। তখন তারা আমার নিকট আসবে, আর আমি তাদের আশ্বস্ত করে বলবো, আমিই এ ব্যাপারে সক্ষম। তখন আমি আমার প্রতিপালকের নিকট অনুমতি প্রার্থনা করবো।“
[তথ্যসূত্রঃ– সহীহ বুখারী শরীফঃ ৪৭১২, ৭৫১০]
এ কারণেই মহানবী (দঃ) হলেন শাফিউল মুজনেবীন। গোনাহগারের জন্য শাফায়াতকারী। নেক্কারবান্দাগণ, আল্লাহর ওলীগণ, গাউস, কুতুব, আব্দাল, মুত্তাকীগণ নিজ নিজ কর্মের দ্বারা জান্নাতে যাবার অধিকার রাখেন। পাপী বান্দারা মহানবী (দঃ) এর শাফায়াতের ফলে সেদিন নাজাত পাবেন। সেদিন তিনি হাউসে কাউসারের পেয়ালা হাতে পাপী (শিরকমুক্ত) উম্মতের জন্যে অপেক্ষা করবেন। এ বিষয়ে সহীহ হাদিসগ্রন্থগুলোতে অসংখ্য হাদিস রয়েছে। একমাত্র শিরককারী ব্যতীত সেদিন প্রতিটি ঈমানদার কিন্তু পাপী বান্দা একে একে জান্নাতে প্রবেশ করবে। মহানবী (দঃ) জাহান্নামের দরজায় গিয়ে কড়া নেড়ে নেড়ে সেদিন তাঁর পাপী উম্মতদের পার করবেন।
“তাদের অনেকই আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থির না করে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে না“। একমাত্র আল্লাহ পাকের আনুগত্যের নাম ইসলাম নয়। তবে কেবলমাত্র রাসুল (দঃ) এর আনুগত্যের নাম ইসলাম। কেননা অনেক মুশরিক আল্লাহর আনুগত্য করত। নাস্তিক ব্যতীত পৃথিবীর সবাই আল্লাহ্কে মান্য করে। এক প্রবল ক্ষমতাশালী কেউ আছেন এমন বিশ্বাস রাখে। কিন্তু তারা কিন্তু মুসলমান নয়। একমাত্র রাসুল (দঃ) এর উপর ঈমান আনা এবং তাঁকে ভালোবাসাই হল ঈমানের মাপকাঠি এবং মুক্তির পথ। তাঁর সাথে বেয়াদবির ফল হল আমল বাতিল। যার আমল বাতিল তার কি আর অন্য কোন উপায় আছে?
সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনুহুম) নবী (দঃ) এর কণ্ঠের উপরে কণ্ঠ তোলায় আল্লাহ পাক সাথে সাথে আয়াত নাজিল করে কেমন হুশিয়ারি দিয়েছেন দেখুনঃ “মুমিনগণ! তোমরা নবীর কন্ঠস্বরের উপর তোমাদের কন্ঠস্বর উঁচু করো না এবং তোমরা একে অপরের সাথে যেরূপ উঁচুস্বরে কথা বল, তাঁর সাথে সেরূপ উঁচুস্বরে কথা বলো না। এতে তোমাদের কর্ম নিস্ফল হয়ে যাবে এবং তোমরা টেরও পাবে না।” (৪৯:২)
আর এ কারণেই কোন এক কবি বলে গেছেন,
خدا جسکو پکڑے چھوڑالے محمد
محمد جو پکڑے چھوڑا کوءی نہیں سکتا-
“খোদা কাউকে পাকড়াও করলে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা শাফায়াত করে তাকে ছাড়িয়ে আনবেন বলে প্রমাণ আছে। কিন্তু মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা কাউকে পাকড়াও করলে তাকে ছাড়িয়ে নেয়ার কেউ নাই”
আর এ কথাটিই আল্লামা হাফেজ আব্দুল জলিল (রহঃ) বলেছিলেন। মুর্খ জাহেলরা তা না বুঝে আল্লাহর একজন ওলীর নামে কেমন অপবাদ দিচ্ছে! আল্লাহ তাদেরকে এর প্রতিদা দেবেন নিশ্চয়ই।
Recent Comments